মাথাব্যথার স্থায়িত্ব, প্রকৃতি, আনুষঙ্গিক অন্যান্য উপসর্গের উপস্থিতি এবং অন্তর্নিহিত কারণের উপর ভিত্তি করে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- প্রাথমিক বা প্রাইমারি পর্যায়ের মাথাব্যথা এবং সেকেন্ডারি পর্যায়ের মাথাব্যথা। মাইগ্রেন, টেনশন টাইপ হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক, অক্সিপিটাল নিউরালজিয়া ইত্যাদি হলো প্রাথমিক পর্যায়ের মাথাব্যথা।
টেনশন টাইপ হেডেক: এটি এক ধরনের প্রাথমিক পর্যায়ের মাথাব্যথা। মাথাব্যথায় আক্রান্ত মোট রোগীর প্রায় ৭০% এ ধরনের ব্যথায় ভোগেন। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এ মাথাব্যথার মূল কারণ হলো মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা বা যেকোনো মানসিক সমস্যা থেকে উদ্ভুত মাথার মাংসপেশীর সংকোচন। তবে প্রত্যেক মানুষেরই যে মানসিক চাপ হলে মাথাব্যথা হবে, ব্যাপারটা কিন্তু এরকম নয়।
এটি যেমন বংশগতিতত্ত্ব এবং ব্যক্তির উপর নির্ভর করে, তেমনই চাপের ধরন, চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এবং স্ট্রেসের প্রতি ব্যক্তির দৃষ্টিকোণের ওপরও নির্ভর করে। স্ট্রেসের ফলে নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তন, শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন, শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, রক্তনালীর প্রসারণ প্রভৃতি সম্মিলিতভাবে টেনশন হেডেকের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৩-১৯ বছর বয়সে প্রথম টেনশন হেডেক শুরু হতে দেখা যায়; তবে ৩০-৩৯ বছর বয়সীদের মাঝে এ ধরনের মাথাব্যথার তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। যদিও টেনশন টাইপ হেডেকের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে বয়স, জাতি, বর্ণ, অঞ্চল অনুযায়ী ভিন্নতা দেখা যায়। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীদের মাঝে এ সমস্যার প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যথা অধিকাংশ সময়ই মাথার সামনে থেকে শুরু হয়ে পেছনে অনুভূত হয় এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মাথায় ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকের ক্ষেত্রে এ ব্যথা ঘাড়, গলা বা পিঠেও ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি এ ব্যথাকে ‘ধরে থাকা ব্যথা’ কিংবা ‘ব্যান্ডের মত ব্যথা’ হিসাবে বর্ণনা করেন এবং সার্বক্ষণিক মাথা চেপে ধরে আছে, এমনটা অনুভূত হয়। টেনশন টাইপ হেডেক একটানাও হতে পারে, আবার মাঝে মাঝে থেমে পুনরায় শুরু হতে পারে। উল্লেখ্য, দিন বাড়ার সাথে সাথে অথবা স্ট্রেস বাড়ার সাথে সাথে মাথাব্যথার পরিমাণও বাড়তে থাকে। ব্যথা সাধারণত ৩০ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে কয়েকদিন পর্যন্তও থাকতে পারে।
সাধারণত মাইগ্রেনের মত টেনশন টাইপ হেডেকে মাথাব্যথার পাশাপাশি বমি বা আলো ভীতি থাকে না। এছাড়া মাইগ্রেনের মতো টেনশন হেডেকে ততটা তীব্র ব্যথাও হয় না। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করে এ ধরনের মাথাব্যথা থেকে উপশম লাভ করা সম্ভব। তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে এনজিওলাইটিক ধরনের কিছু ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে।
মাইগ্রেন: টেনশন টাইপ হেডেক কিংবা ক্লাস্টার হেডেকের মতো এটিও প্রাথমিক পর্যায়ের এক ধরনের এপিসোডিক অথবা ক্রোনিক এবং পুনরাবৃত্তিমূলক মাথাব্যথার ধরন। মাইগ্রেন শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘হেমিক্রেনিয়া’ থেকে। যার অর্থ হলো মাথার একদিকে ব্যথা। তবে মাইগ্রেনে ব্যথা মাথার একদিকে হয় বলে বিখ্যাত হলেও অনেক সময় ব্যথা পুরো মাথায়ই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭% বয়স্ক মানুষ মাইগ্রেনজনিত মাথাব্যথায় ভোগেন। সাধারণত ২০-৩০ বছর বয়সে এ রোগ শুরু হয়ে থাকে। অনেকেরই ধারণা রয়েছে যে, মাইগ্রেন কেবল নারীদেরই হয়। কিন্তু প্রায় ৮ ভাগ পুরুষ ও ১৮ ভাগ নারী এ সমস্যায় ভুগে থাকেন। নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময় এ ব্যথা আরও বাড়ে। কেবল বড়দেরই নয়, শিশুদেরও আক্রমণ করতে পারে মাইগ্রেন।
অনেকেই মনে করেন, মাইগ্রেন মানে শুধুই মাথাব্যথা। এটি ভুল ধারণা। মাইগ্রেনের অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে একটি হলো মাথাব্যথা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাথাব্যথা ছাড়াও মাইগ্রেন আক্রমণ করতে পারে। তবে যা-ই হোক, মাইগ্রেনের প্রধান লক্ষণ কিন্তু মাথাব্যথা। যা মাথার একপাশ থেকে শুরু হয়ে সমস্ত মাথায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পাশাপাশি চোখের পেছনে ব্যথার অনুভূতিও হতে পারে। মাথাব্যথা শুরু হলে কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। মাথাব্যথার সাথে বমিভাব বা বমি এবং চোখে ঝাপসা দেখাও যুক্ত হতে পারে। বিরক্তি, শব্দ ও আলো ভালো না লাগা, কাজে মনোযোগ নষ্ট হওয়া, অতিরিক্ত হাই তোলা, অতিরিক্ত তেষ্টা পাওয়া, ঘনঘন প্রস্রাব, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি উপসর্গ মাথাব্যথার দু’একদিন আগেই শুরু হতে পারে।
মাথার ভেতরে রক্ত চলাচলের তারতম্যের কারণে মাইগ্রেন শুরু হয়। মস্তিষ্কের বহিরাবরণে বিদ্যমান ধমণীসমূহ মাথাব্যথার শুরুতে স্ফীত হয়ে যায়। এতে মস্তিষ্কে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। ফলে প্রথমে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে গিয়ে চোখে সব অন্ধকার মনে হয়। পরে আবার রক্ত চলাচল হঠাৎ বেড়ে গিয়ে প্রচণ্ড মাথাব্যথার অনুভূতি হয়। নিউরোভাস্কুলার এ অসুখে মাথাব্যথার জন্য সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের অত্যধিক উপস্থিতি দায়ী।
মাইগ্রেনের কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি। এটি বংশগত বা অজ্ঞাত কারণে হতে পারে। আবার চকলেট, আঙুরের রস, কফি ও পনির জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, দুশ্চিন্তা, ব্যায়াম, অতিরিক্ত ভ্রমণ, অনিদ্রা, দীর্ঘদিন জন্মবিরতিকরণ ওষুধ সেবন, দীর্ঘক্ষণ টেলিভিশন দেখা, মোবাইলে কথা বলা ও কম্পিউটারে কাজ করা, অতি উজ্জ্বল আলো, শব্দ, গন্ধ ও বাতাসের চাপের তারতম্য প্রভৃতি মাইগ্রেনের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
জীবনযাপনে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে মাইগ্রেনের তীব্রতা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। বাঁধাকপি, মাশরুম, চেরি, খেজুর, ডুমুর, অরগান মিট, চিংড়ি, আদা-চা প্রভৃতি খাবার মাইগ্রেনের স্থিতি ও পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করে। তিল, আটা, বিট প্রভৃতি ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার, ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত, আলু, বার্লি প্রভৃতি ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার, সবুজ কমলা, হলুদ রঙের শাক-সবজি ইত্যাদিও মাইগ্রেন প্রতিরোধক।
বেশি সময় ধরে টিভি, কম্পিউটার ব্যবহার না করা, উচ্চশব্দ ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলা, তীব্র রোদ ও ঠান্ডা পরিহার করা, কম বা অতিরিক্ত আলোয় কোনো কাজ না করা, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও পরিমিত ঘুম প্রভৃতি নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন মাইগ্রেন প্রতিরোধ করতে পারে। মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেলে বিশেষত বমি হলে প্রচুর পানি পান করা, ঠান্ডা কাপড় মাথায় জড়িয়ে রাখা, বিশ্রাম করা ইত্যাদি মেনে চললে মাথাব্যথার তীব্রতা হ্রাস পায়।
পাশাপাশি মাইগ্রেনে ভুক্তভোগী ব্যক্তির চকলেট, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, পেঁয়াজ, টমেটো, সাদা রুটি, আপেল, কলা, চিনাবাদাম, চা, কফি, কোমলপানীয়, টক জাতীয় ফল, আইসক্রিম, পনিরে বিদ্যমান টাইরামিন প্রভৃতি পরিহার করে চলাই শ্রেয়। ব্যথার তীব্রতা বেশি হলে এবং বারবার আক্রমণ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ও মাইগ্রেন প্রতিরোধী ওষুধ সেবনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও মানসিক চাপ পরিহার করার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
ক্লাস্টার মাথাব্যথা: মাইগ্রেনের চেয়ে এ ধরনের মাথাব্যথার ঘটনা তুলনামূলক কম। ক্লাস্টার মাথাব্যথা হঠাৎ করেই শুরু হয়, তবে আস্তে আস্তে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ব্যথা একপাশে শুরু হয়ে অনেক সময় চোখের পেছনের দিকেও প্রবাহিত হয়ে তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় নাক, চোখ বা ব্যথার স্থান লাল বর্ণও ধারণ করতে পারে। পাশাপাশি চোখে তীব্র জ্বালাপোড়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, দৃষ্টিশক্তিতে সামান্য ব্যাঘাত ঘটা প্রভৃতি উপসর্গও উপস্থিত থাকতে পারে। তীব্র আলো, ঘ্রাণ বা গন্ধ এবং শব্দে এ ধরনের মাথাব্যথা বেড়ে যায়।
ক্লাস্টার মাথাব্যথা ১৫ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং সাধারণত প্রতিদিন একই সময়ে ঘটে। এমনকি একই দিনে কয়েকবার এ ব্যথার আক্রমণ হতে পারে। এটি প্রাথমিক পর্যায়ের পুনরাবৃত্তিমূলক এক ধরনের তীব্র মাথাব্যথা হিসাবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। এজন্যই একে ক্লাস্টার মাথাব্যথা হিসাবে অভিহিত করা হয়। নারীর চেয়ে মধ্যবয়সী পুরুষের মাঝে এ ধরনের মাথাব্যথার ঘটনা সবচেয়ে বেশি।
মাইগ্রেনের চিকিৎসা এবং ক্লাস্টার মাথাব্যথার চিকিৎসা একই। তবে তীব্র ব্যথা হলে আর্গোটামিন কিংবা ভেরাপামিল জাতীয় ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। শতকরা ৫০ ভাগের বেশি রোগী ফেস মাস্কের মাধ্যমে শ্বাসের সাথে ১০০% অক্সিজেন গ্রহণেও বেশ উপকার লাভ করেন। এ ছাড়া মদ্যপান ও ধূমপান ত্যাগ, সঠিক সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস প্রভৃতি এ ধরনের মাথাব্যথা থেকে মুক্ত রাখতে সহায়তা করে।